সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬

সাজিদের কাগজ

ডানপিটে ছিলেন। মেধাবীও ছিলেন। তাই খেলার মাঠ আর পড়ার টেবিল সব জায়গায়ই পাওয়া যেত সাজিদকে। ফুটবল-ক্রিকেট দুটিই ভালো খেলতেন সাজিদ। ফুটবলে ছিলেন স্ট্রাইকার, ক্রিকেটে ওপেনিং ব্যাটসম্যান। খুলনা ব্রাদার্সের হয়ে খেলেছেন। পয়েন্ট অঞ্চলে ফিল্ডিং করতেন। বন্ধুরা ডাকত জন্টি রোডস বলে। একবার কলেজের এক ছেলের সঙ্গে মারপিট করলেন। ছেলেটির বাবা ক্ষমতাবান ছিলেন। মামলাও ঠুকে দিয়েছিলেন। বাবা বলেছিলেন, চোখের সামনে থেকে দূর হ! বাড়ি ছাড়লেন সাজিদ।


১৯৯৭ সালে ঢাকায় আসেন। ধানমণ্ডিতে ‘মহসিন ভাইয়ের মেসে’ ওঠেন। ভর্তি হন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে। পড়তে থাকেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (সিএসই)। টিউশনি করে টেনেটুনে চলে যেত। দূরসম্পর্কের এক মামা ছিলেন ঢাকায়। মামা বিদেশি কম্পানিগুলোয় ইলেকট্রিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতেন। সাজিদ প্রায়ই যেতেন মামার অফিসে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়।  নিজেই করতে চাইলেন ব্যবসা। ছোট মামার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিলেন। চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময় গড়ে তুললেন কাজী করপোরেশন লিমিটেড। বৈদ্যুতিক মিটার, সুইচ গিয়ারসহ আরো কিছু পণ্য আনতে শুরু করেন বিদেশ থেকে। তখন বৈদ্যুতিক মিটারে সিসার সিল ব্যবহার করা হতো। এখন সিল হয় প্লাস্টিকের। ২০০৩ সালে প্লাস্টিকের সিল আমদানির জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দরপত্র আহ্বান করে। কাজী করপোরেশন সর্বনিম্ন দরদাতা হলো। কিন্তু কাজটা পেল না। কারণ জানতে গেলেন পিডিবি অফিসে। চেয়ারম্যানের সঙ্গেই দেখা করলেন। সব শুনে চেয়ারম্যান দরপত্র রিভিউ করার নির্দেশ দিলেন। শেষমেশ কাজটা পেয়ে ১০ লাখ পিস সিল সরবরাহ করেছিলেন সাজিদ।


শেয়ারবাজারে
২০০৮ সালে সাজিদ চাইলেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে। প্রথমদিকে শেয়ার কিনতেন না। বিও অ্যাকাউন্ট খুলে কয়েক দিন বাজার পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। তখন ‘স্টক মার্কেট বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটা সফটওয়্যার ছিল। সাজিদ নিজের জন্য সফটওয়্যারটির একটি আপডেট ভার্সন তৈরি করলেন। নিত্যই শেয়ার বেচাকেনা করলেন। লাভও পেলেন ভালো।

মাকে নিয়ে হজ
২০১০ সালের ২ নভেম্বর মাকে নিয়ে হজে যান সাজিদ। হজ শেষে মদিনা শরিফ যান। একদিন মসজিদে নববীতে মাগরিবের নামাজ পড়তে যান। সেদিন রোজাও রেখেছিলেন। ইফতারের সময় সৌদি এক ভদ্রলোক তাঁকে একটা পেপার কাপে কফি আরেকটা কাপে অনেকগুলো খেজুর দিলেন। কাপ দুটি দেখতেও খুব ভালো ছিল। সাজিদ কফি শেষ করলেন, কিন্তু নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় সব খেজুর শেষ করতে পারেননি। নামাজ শেষে খেজুরের কাপটা নিয়ে বাসায় এলেন। রাতে শুয়ে শুয়ে খেজুর খাচ্ছেন আর ভাবছেন, আমি কি এমন কাগজের কাপ বানাতে পারব না? তখনই স্মার্টফোনে ‘পেপার কাপ’ লিখে গুগলে সার্চ দিলেন। ‘সেখানে দুটি বাক্য দেখে আমার খুব ভালো লাগল। এগুলো হলো—‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট ইকো ফ্রেন্ডলি এবং হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফুড গ্রেড।’ বললেন সাজিদ। নভেম্বরের ২১ তারিখ দেশে ফিরে আসেন। দুই দিন পর মতিঝিলের শেয়ার মার্কেটে যান। নিজের কেনা সব শেয়ার বেচে দেন। সাজিদের মাথায় তখন কেবলই পেপার কাপ। আমদানি করে ব্যবসা নয়, দেশে নিজের কারখানায় উৎপাদন করতে চান। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করলেন। খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, বিশ্ববাজারে মালয়েশিয়ার মালেক্স কম্পানির খুব নামডাক। পেপার কাপ নিয়ে হাতে-কলমে শেখার জন্য ২০১১ সালে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান সাজিদ। সেখানে দুই মাস ছিলেন।

স্বপ্নযাত্রা
দেশে ফিরে নিজের কম্পানির নাম ঠিক করলেন—কাজী পেপার কাপ ইন্ডাস্ট্রি (কেপিসি)। প্রতিপাদ্য ‘লেট দি এনভায়রনমেন্ট লিভ, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু লিভ’। কম্পানি প্রোফাইল তৈরি করে জমা দিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। প্রোফাইল দেখে ৩০ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করল ব্যাংক। হাতে নিজের আরো ১০ লাখ ছিল। সব মিলিয়ে ৪০ লাখ হলো পুঁজি। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারখানার যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলেন। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় এক হাজার ২০০ বর্গফুটের একটা ঘরও ভাড়া নেন। লোক বলতে সাজিদ নিজে আর তিনজন কর্মচারী। এ নিয়েই এপ্রিল মাসে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে পেপার কাপ উৎপাদন করেন। ‘প্রথম দিন তো পুরো রাত জেগে সব তদারকি করছিলাম। মেশিন থেকে একেকটা কাপ নয় যেন মূর্ত হয়ে আমার স্বপ্ন বের হচ্ছিল।’

‘আব্বু, অর্ডার পেয়ে গেছি’
২০১২ সালের জুন মাসে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসে কেপিসি। সেই দিনটির কথা আজও মনে আছে সাজিদের। মোটরবাইকের পেছনে নিজের উৎপাদিত পেপার কাপ ও প্লেটের কিছু নমুনা নিয়ে উত্তরায় শেভরনের নিবন্ধিত সরবরাহকারীর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সরবরাহকারী কাপগুলো নেড়েচেড়ে দেখে খুশি হয়ে গেলেন। আগেরগুলোর তুলনায় সাজিদের কাপগুলো গুণগতমানে যেমন ভালো, দেখতেও ভালো। প্রথমবারেই মাসে দুই লাখ কাপের অর্ডার পান। সাজিদ বললেন, ‘দিনটি ছিল স্বপ্নের মতো। কিছুটা দুঃসাহস নিয়েই প্রথমে তাদের কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের কাপের মান আর নকশার প্রশংসা করেছিলেন তাঁরা। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে সফল হতে পেরেছি। দারুণ আনন্দের ছিল ব্যাপারটি।’ অর্ডার পেয়ে বাবাকে ফোন করেন সাজিদ—আব্বু, আমি অর্ডার পেয়ে গেছি। এর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে চার-পাঁচটি কম্পানির অর্ডার আসতে থাকে। পেপসির কাছ থেকেও অর্ডার পান প্রথম মাসেই।

গ্রাহক কারা
আপনি কি কখনো ক্যাম্পাসে কিংবা পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় কাপে ভরা ইগলুর আইসক্রিম খেয়েছেন? কিংবা রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতে দিতে নেসক্যাফে লেখা পেপার কাপে চুমুক দিয়েছেন? তাহলে আপনি কেপিসির গ্রাহক! এগুলো যে কেপিসির তৈরি! সাজিদের গ্রাহকতালিকায় আছে ব্রিটিশ কাউন্সিল, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার, নেসলে, ওয়েস্টিন, সোনারগাঁও হোটেল, ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশন, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, বসুন্ধরা গ্রুপ, অ্যাপোলো হসপিটাল, ইউনাইটেড হসপিটাল, ইস্পাহানি, ডানো, প্রাণ, আকিজ গ্রুপ, বুমারস ক্যাফে, বাংলা কফি, বিএফসির মতো দেশি-বিদেশি ১৭০টির বেশি প্রতিষ্ঠান। দিনকে দিন এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম।

- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/oboshore/2016/08/20/395432#sthash.niTxxQUP.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads Inside Post

Comments system

Disqus Shortname

Flickr User ID